চণ্ডীমঙ্গল
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী দুই খণ্ডে বিভক্ত – (i) আক্ষেটিক খণ্ড (ii) বণিক খণ্ড
***চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের চরিত্র – কালকেতু, ফুল্লরা, ভাঁড়ুদত্ত, মুরারীশীল, কলিঙ্গরাজ, দাসী দুর্বলা ।
* বণিক খণ্ডে জয়াবতী – ধনপতি সদাগর, লহনা, খুলনা, খুলনার পুত্র- শ্রীমন্ত, শ্রীমন্তের স্ত্রী- জয়াবতি
* মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতিবাদী নারী চরিত্র- ফুল্লরা।
* ষড়যন্ত্রকারী বা খল চরিত্র- ভাঁড়ুদত্ত ।
*ঠক বা প্রতারক বা ধূর্তচরিত্র- মুরারীশীল ।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবিঃ
(i)কবি মানিকদত্ত- আদি কবি ।
(ii) দ্বিজ মাধব- তাঁর কাব্যের নাম ‘সারদামঙ্গল’/‘সারদাচরিত’ তাঁকে স্বভাবকবি বলা হয় ।
(iii) দ্বিজ রামদেব- তাঁর কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’ । ডঃ আশুতোষ দাস তাঁর কাব্য আবিষ্কার ও প্রকাশ ৱায় ।
(iv) ***মুকুন্দরাম চক্রবর্তী- তিনি চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি । জন্ম- দামুন্যা গ্রাম, বর্ধমান জেলায় ।
→ মেদেনীপুর জেলার আড়রা গ্রামের জমিদার রঘুনাথ রায়- মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে ‘কবি কঙ্কন’ উপাধি প্রদান করেন ।
→ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে- দুঃখ বর্ণনার কবি বলা হয় । তিনি ষোড়শ শতকের কবি । কাব্য- ‘অভয়ামঙ্গল’
→ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর সম্পর্কে বলা হয়- মধ্যযুগে জন্মগ্রহণ না করে আধুনিক যুগে জন্মগ্রহণ করলে কবি না হয়ে ঔপন্যাসিক হতেন ।
(v) মুক্তারাম সেন– কাব্যের নাম: ‘সারদামঙ্গল’ ।
(vi) অকিঞ্চন চক্রবর্তী– চণ্ডীমঙ্গলের সর্বশেষ কবি । উপাধি -কবীন্দ্ৰ । ।
চণ্ডীমঙ্গলের আখ্যান [নির্দেশনাঃ শুধু জানার জন্য পড়ুন]
যতগুলি বাংলা চণ্ডীমঙ্গল পাওয়া গেছে তাদের প্রত্যেকটিতেই দুটি কাহিনী লক্ষ্য করা যায়একটি আক্ষেটিক খণ্ড, অর্থাৎ ব্যাধ কালকেতুর গল্প আর একটি বণিক খণ্ড, অর্থাৎ বণিক ধনপতির গল্প ।
আক্ষেটিক খণ্ডের কাহিনী
প্রথম কাহিনীতে কালকেতুর গল্পে দেবী কর্তৃক অনার্য ব্যাধসমাজে সর্ব প্রথম পূজা গ্রহণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে । ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর সামান্য অপরাধের জন্য মর্ত্যে ব্যাধের ঘরে কালকেতু নামে জন্মগ্রহণ করল, তার স্ত্রী ছায়াও স্বামীর অনুমৃতা হয়ে মর্ত্যে ফুল্লরা ব্যাধিণী রূপে জন্ম নিল । উভয়ের যথারীতি বিবাহ হল । তারা কিন্তু পূর্বস্বরূপ সম্পূর্ণ ভুলে গেল ।
দেবী এই নির্লোভ ব্যাধদম্পতির দ্বারা প্রথম পূজা প্রচারের জন্য সচেষ্ট হলেন। একদিন দেবী কালকেতুর পথের মধ্যে স্বর্ণ গোধিকা (গো-সাপ) হয়ে পড়ে রইলেন। কালকেতু সেদিন কোন শিকার পেল না। সে মনে করল, এই স্বর্ণ গোধিকার অশুভ দর্শনেই সে শিকারে ব্যর্থ হয়েছে। রেগে গিয়ে স্বর্ণ গোধিকাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাড়ী নিয়ে এল ইচ্ছে- পুড়িয়ে খাবে। এই ভেবে সে হাটে গেল। ইতিমধ্যে দেবী স্বর্ণ গোধিকামূর্তি ছেড়ে অপূর্ব রূপসীর রূপ ধরে ব্যাধের কুটীর আলো করে রইলেন। এদিকে কালকেতু – ফুল্লরা এ ব্যাপার দেখে অবাক হলেন। তাদের মাধ্যমেই পূজা প্রচারে ইচ্ছুক দেবী তাদের কৃপা করলেন, বহু ধনসম্পত্তি দিলেন । সেই ধনের দ্বারা ব্যাধ কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর স্থাপন করল, সে রাজা হল। তার রাজ্যে বহু প্রজা এসে সুখে বাস করতে লাগল, সে মহানন্দে দেবীর পূজা করতে লাগল। কিন্তু তাঁর কাছে ভাঁড়ুদত্ত নামক একজন খলপ্রকৃতির লোক এসে বাকচাতুরীতে তাকে মুগ্ধ করে নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে লাগল। এ কথা জানতে পেরে কালকেতু তাকে খুব ভর্ৎসনা করল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ভাঁড়ুদত্ত পাশের রাজ্য কলিঙ্গে গিয়ে সে দেশের রাজাকে কালকেতুর বাড়বাড়ন্তে র সংবাদ দিল। এতে কলিঙ্গরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যাধরাজা কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। কালকেতু খুব বীরের মতো লড়লেও খল ভাঁড়ুদত্ত কৌশলে তাঁকে ধরিয়ে দিলেন । কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। সেখানে কালকেতু দেবির স্ত ব করলে তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে রাতে কলিঙ্গ রাজাকে দুঃস্বপ্ন দেখালেন এবং ভীষণ ভয় পাইয়ে দিলেন । কলিঙ্গরাজ বুঝতে পারলেন, কালকেতু দেবীর পরম ভক্ত । তখন কলিঙ্গরাজ সসম্মানে কালকেতুকে মুক্তি দিলেন এবং তাকে রাজটীকা দিয়ে সর্বসমক্ষে রাজা বলে স্বীকার । করলেন।
কালকেতু মহাসমারোহে নিজ রাজ্যে ফিরে এলেন । এদিকে ভাঁড়ুদত্ত দেখল পাশা উল্টে গেছে । সে তাড়াতাড়ি কালকেতুর কাছে এসে মিষ্টি কথা বলতে লাগল । কিন্তু এবার কালকেতু আর তার বাকচাতুরীতে ভুলল না, তাকে খুব অপদস্থ ও অপমানিত করে তাড়িয়ে দিল । তারপরে তাকে নানাভাবে উৎপীড়িত হতে দেখে কালকেতু দয়াবশত আবার তার ঘরবাড়ি ফিরিয়ে দিল । মর্ত্যে কালকেতুর দ্বারা দেবীর পূজা প্রচারিত হল, স্বর্গের নীলাম্বর ও ছায়া মর্ত্যে কায়া ত্যাগ করে আবার স্বর্গে ফিরে এল । তাদের একমাত্র পুত্র পুষ্পকেতু ভগ্ন হৃদয়ে গুজরাটে রাজ্যপাট চালাতে লাগল । এই হল ব্যাধের দ্বারা সর্বপ্রথম চণ্ডীর পূজা প্রচারের কাহিনী ।
বণিক খণ্ডের কাহিনী
স্বর্গের নর্তকী রত্নমালা নাচের সময় তাল ভুল করার জন্য অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে খলনারূপে জন্মগ্রহণ করল । দেবী তার দ্বারা নিজের পূজা প্রচারের জন্য সচেষ্ট হলেন । খুলনা প্রাপ্তবয়স্ক হলে ধনপতি সদাগর তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিবাহ করে । ধনপতির আরেক স্ত্রী ছিল, তার নাম লহনা। বিয়ের পর ধনপতি কিছুকালের জন্য গৌড়ে গেলে লহনা সতীন খুলনার ওপর অত্যাচার শুরু করল। তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেবার জন্য সে স্বামীর নামে এক জালপত্র লিখে তার সাহায্যে যুবতী খুলনাকে বনে বনে ছাগল চরাতে নিযুক্ত করল, ঢে’কিশালে শুতে দিল, খাবারে দারুণ কষ্টে দিতে লাগল। এদিকে খুলনা চোখের জল ফেলে সেই কাজই করতে লাগল। একদিন সে বনের মধ্যে চণ্ডীপূজা দেখে নিজেও মঙ্গলচণ্ডীর পূজা করলে ক্রমে তার দুঃখের দিন অবসান হল, লহনা নিজ কার্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তাকে আবার গৃহে ঠাঁই দিল ।
ধনপতি বাড়ি ফিরে এই খবর জানতে পেরে লহনাকে খুব ভৎসনা করল। কিছুকাল পরে ধনপতিকে রাজার নির্দেশে বাণিজ্যের নৌকা সাজিয়ে সিংহল যাত্রা করল তখন খুলনা সন্তানসম্ভবা। খুলনা স্বামীর মঙ্গল কামনায় একদিন ঘট পেতে মঙ্গল চণ্ডীর পূজা করেছিল এই খবর জানতে পেরে শৈব ধনপতি দেবীর ঘটে পদাঘাত করে। তার জন্য বাণিজ্যে বেরিয়ে তাকে খুব শাস্তি ভোগ করতে হল, ঝড়ে তার অনেকগুলি নৌকা ডুবে গেল। সে কোনক্রমে সিংহলে উপস্থিত হল। পথে কালীদহে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। ফুটন্ত পদ্মফুলের উপর বসে এক অপূর্ব সুন্দরী রমণী একটা হাতীকে গিলে ফেলছেন আবার তা উদগীরণ করে ফেলছেন। এই মূর্তির নাম কমলে কামিনী। সিংহলে গিয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্যের কথা সে সিংহলের রাজার কাছে বললেন রাজা তো এ ঘটনা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। সে বলল যে, রাজাকে যদি এ দৃশ্য না দেখাতে পারে তবে সে সারাজীবন রাজার কারাগারে বন্দী হয়ে থাকবে । সে দম্ভভরে এ দৃশ্য দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হল, তাকে সিংহলের কারাগারে পাওনা শাস্তি ভোগ করতে হল।
ইতিমধ্যে অনেক দিন কেটে গেছে, তার ছেলে শ্রীমন্ত ক্রমে বড় হয়েছে । বহুদিন যাবৎ পিতার কোনো সংবাদ না পেয়ে সে মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে পিতার সন্ধানে সিংহল যাত্রা করল । শ্রীমন্ত মালাধর নামে স্বর্গের এক অধিবাসী। সেও কিন্তু অভিশপ্ত হয়ে খুলনার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করলেন। পথিমধ্যে শ্রীমন্ত ধনপতির মতো কমলে-কামিনী দেখতে পেল এবং সিংহল রাজার কাছে এসেই সেই দৃশ্যের গল্প করল। তার পরের ঘটনা ধনপতির ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। এবার রাজা মিথ্যাবাদীকে শুলে দিতে চাইলেন। কিন্তু দেবীর অনুগৃহীত এবং স্নেহের পাত্র ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত দেবীর কৃপাতেই রক্ষা পেল ।
সিংহলরাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলেন । অবশেষে সব কিছু ভালোর দিকে চলল। সিংহলরাজ তাঁর কন্যা সুশীলার সাথে শ্রীমন্ত এর মহা ধুমধাম করে বিয়ে হল। কিছুকাল সিংহলে অতিবাহিত করার পর ধনপতি পুত্র পুত্রবধুসহ নিজ দেশে ফিরে এল। এবার সে পরমভক্তিতে চণ্ডী দেবীর পূজা করল। এবার সহজে মর্ত্যে উচ্চ সমাজে দেবীর পূজা প্রচারিত হইল । তার পরে কাল পূর্ণ হল স্বর্গের রত্নমালা ও মালাধর স্বর্গে ফিরে গেল, মর্ত্যে ধনপতি বিলাপ করার জন্য পড়ে রইল ।