অন্নদামঙ্গল

ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরঃ

* ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নদামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি। ভুরসুট পরগনার আধুনিক হাওড়া জেলার পেঁড়ো (পাণ্ডুয়া) গ্রামে জন্ম ১৭১২ খ্রিঃ এবং মৃত্যু ১৭৬০ খ্রি: । তিনি মধ্যযুগের তথা বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি । ভারতচন্দ্রের কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “রাজ সভাকবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য রাজকন্ঠের মনিমালার মত; যেমন তাহার উজ্জলতা তেমনি তাহার কারুকার্য ।” –

* কালিকামঙ্গল ও বিদ্যাসুন্দর এই কাব্যের অংশমাত্র ।

* নবদ্বীপ বা নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র কবিকে ‘গুণাকর’ উপাধি প্রদান করে। ‘রায়’ তাঁর পারিবারিক পদবি ।

অন্যান্য রচনা :

(i) চণ্ডীনাটক- অসমাপ্ত

(ii) নাগাষ্টক ও ষ্টক’- নামক সংস্কৃত কবিত

(iii) সত্যপীরের পাঁচালি ।

অন্নদামঙ্গল বা অন্নপূর্ণামঙ্গলের আটটি পালা। কাব্যটি তিন খণ্ডে বিভক্ত।


প্রথম খণ্ড – শিবায়ন অন্নদামঙ্গল।

দ্বিতীয় তৃতীয় খণ্ড – মানসিংহ অন্নদামঙ্গল ।

 চরিত্র- ঈশ্বরী পাটনী, হীরা মালিনী, মানসিংহ, ভবানন্দ, সম্রাট জাহাঙ্গীর, রাজা প্রতাপাদিত্য, দাসু, বাসু, সাধী, মাধী, পাতশা, হরিহোড়। 

***‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ উক্তিটি দেবী অন্নদাকে ঈশ্বরী পাটনী বলেছিল।

তৃতীয় খণ্ড – বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল। 

ভারতচন্দ্র রচিত গুরুত্বপূর্ণ উক্তি

(১) মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন । 

(২) নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায় ।

(৩) যতন নহিলে নাহি মিলায়ে রতন । 

(৪) দেখিতে দেখিতে ধন ধান্য উড়ে যায় ।

(৫) কড়িতে বাঘের দুধ মিলে । 

(৬) জন্মভূমি জননী স্বর্গের গরিয়সী ।

(৭) মিছাকথা সিচাজল কতক্ষণ রয় । 

(৮) আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে । 

(৯) বড়র পিরীত কালির বাঁধ/ ক্ষণেক হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ | 

(১০) হাভাতে যপ্যদি চায় সাগর শুকায়ে যায় ।

(১১) ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন । 

অন্নদামঙ্গল কাব্যের আখ্যান[নির্দেশনাঃ শুধু জানার জন্য পড়ুন]

ভারতচন্দ্র অমর হয়েছেন তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যের কারণে। “ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে”- সে গুণ হল অন্নদামঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত তিনখানি কাব্য- ১. শিবায়ন অন্নদামঙ্গল ২. কালিকামঙ্গল বিদ্যাসুন্দর ৩. মানসিংহ অন্নদা মঙ্গল ।

অন্নদামঙ্গলের প্রথমে আলিবর্দি কর্তৃক ভারতচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে কারাকক্ষে নিক্ষেপ এবং কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক অন্নপূর্ণা পূজা করে বিপদ থেকে উদ্ধারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে । অতঃপর কবি সংস্কৃত ‘কাশীখণ্ড’ এবং অন্যান্য শিবপুরাণ অবলম্বনে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ, হিমালয় গৃহে দেবীর উমারূপে জন্ম এবং শঙ্কর-উমার বিবাহের বর্ণনার পর কাশীধামে অন্নপূর্ণার অধিকারের বর্ণনা করেছেন। তারপরে ব্যাসপ্রসঙ্গ আরম্ভ হয়েছে। বুদ্ধিহত বুড়ো ব্যাসদেব অন্নপূর্ণার কাশীর মহিমা ক্ষুণ্ন করে নতুন কাশী নির্মাণ করতে গিয়ে কি রকম নাজেহাল হয়েছিলেন, খুব চমৎকার রসিকতার সঙ্গে কবি তার বিবরণ দিয়েছেন। কাশীধামে দেবীর মহিমা প্রতিষ্ঠার পর তিনি মর্ত্যে শিবপূজা প্রচারের জন্য সচেষ্ট হলেন এবং কুবেরের অনুচরকে শাপ দিয়ে হরিহোড় নাম নিয়ে পৃথিবীতে এক দরিদ্রের ঘরে জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য করলেন । হরিহোড় মর্ত্যে জন্ম নিয়ে দেবীর কৃপায় দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে খুব ঘটা করে অন্নপূর্ণা পুজা প্রচার করলেন। কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছে তিনি তরুণী ভার্যাকে ঘরে এনে মহা অশান্তি সৃষ্টি করলেন । দেবী তখন হরিহোড়কে ছেড়ে অন্য কাউকে কৃপা করতে মনস্থির করলেন । ইতিপূর্বে তিনি কুবেরের পুত্র নলকুবেরকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়ে মর্ত্যে পাঠিয়েছিলেন । তিনিই ভবানন্দ মজুমদার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ । ভবানন্দ সাধুসজ্জন ছিলেন ।

মুঘলের সঙ্গে প্রতাপের যুদ্ধে মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন। হরিহোড়ের গৃহ ছেড়ে দেবী পরম ধার্মিক ভবানন্দের গৃহে গেলেন। এই হলো অন্নদামঙ্গলের প্রথম অংশের কাহিনী । দ্বিতীয় কাহিনী কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর। সংস্কৃত ‘চৌরপঞ্চাশিকা’ নামে উদ্ভট শ্লোক সংগ্রহ এবং পূর্ববর্তী কবিদের বিদ্যাসুন্দর কাহিনী অনুসরণে ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত দ্বিতীয় আখ্যান কালিকামঙ্গল বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন। রাজকুমারী বিদ্যা ও রাজকুমার সুন্দরের গোপন প্রেম, বিদ্যার পিতা মহারাজ বীরসিংহ কর্তৃক সুন্দর চোর ধরা শিরোচ্ছেদের জন্য মশানে নিয়ে যাওয়া, কালিকার কৃপায় ভক্ত সুন্দরের রক্ষা পাওয়া, পরিশেষে বিদ্যা ও সুন্দরের বিবাহ, প্রভৃতি বহু প্রচলিত কাহিনীই তাঁর অবলম্বন। হীরামালিনী, বিদ্যার মাতা, নগরপাল কোটাল ইত্যাদি অপ্রধান চরিত্রগুলি অধিকতর সুচিত্রিত হয়েছে। এ কাব্যের বহুস্থলে অনাবৃত আপত্তিকর বর্ণনা আছে বলে ভারতচন্দ্র অশ্লীল কবি বলে কুখ্যাতি লাভ করেছেন । কুখ্যাতি বা সুখ্যাতি- যাই হোক না কেন, ‘বিদ্যাসুন্দর’ এর জন্য ভারত চন্দ্র রায়গুণাকর বাংলা সাহিত্যে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন ।

অন্নদামঙ্গলের শেষ অংশ ‘মানসিংহ’ অন্নদামঙ্গল । ভবানন্দ মজুমদারের সহায়তায় মানসিংহ যুদ্ধে প্রতাপাদিত্যকে পরাভূত করে তাকে খাঁচায় ভরে নিয়ে চললেন জাহাঙ্গীর বাদশাহকে উপহার দেবার জন্য । ভবানন্দকে মানসিংহ উচ্চ প্রশংসা করলেন এবং তাঁকেও সঙ্গে করে দিল্লী নিয়ে চললেন । অন্নন্দার বরপুত্র ভবানন্দের সহায়তায় এবং দেবীর কৃপা না পেলে মুঘলবাহিনী প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে কিছুতেই দাঁড়াতে পারত না। খাঁচায় বন্দী প্রতাপাদিত্যকে জীবন্ত অবস্থায় আর দিল্লী নিয়ে যাওয়া গেল না, বাংলার বীর পথিমধ্যে দেহত্যাগ করলেন । মানসিংহ তখন প্রতাপের মৃতদেহ ঘিয়ে ভেজে শুষ্ক করে নিয়ে চললেন- জীবিত বা মৃত শত্রুর দেহ বাদশাহকে উপঢৌকন দিতেই হবে। বাদশাহ অত্যন্ত খুশি হলেন বটে, কিন্তু যখন শুনলেন যে অন্নপূর্ণার কৃপাপুষ্ট ভবানন্দ মজুমদার নামক ব্রাহ্মণের দৈব ক্ষমতার এই জয় সমাধা হয়েছে তখন তিনি ধর্মীয় অনুদারবশতঃ অন্নপূর্ণার উদ্দেশে অতি জঘন্য বাক্যে প্রয়োগ করেন ৷ ভবানন্দ তার প্রতিবাদ করলে তাঁকে নিকৃষ্ট কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হল । মানসিংহ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অপমানিত ও দুঃখিত চিত্তে স্থান ত্যাগ করলেন। কিন্তু তারপর গোটা দিল্লী শহরে মুসলমান আমীর ওমরাহ এবং খোদ জাহাঙ্গীর বড়ই বিপদে পড়লেন । যে হিন্দুদের দেবীকে তিনি অপমানিত করেছিলেন সেই দেবীর অনুচর ভূত-প্রেতেরা দিল্লী শহর ভেঙে তছনছ করে দিল; মুসলমানদের মারধোর করে ব্যাতিব্যস্ত করে তুলল । তখন বাধ্য হয়ে বাদশা জাহাঙ্গীর ভবানন্দকে প্রচুর খেলাত ও জমিদারী দিয়ে এবং সপরিষদ অন্নন্দার পূজা করে বিপদ থেকে উদ্ধার পেলেন । রাজা উপাধি, বিস্তৃত জমিদারী ও নানা উপহার নিয়ে ভবানন্দ দেশে ফিরলেন এবং দুই স্ত্রী নিয়ে সুখে ঘর করতে লাগলেন । যথাসময়ে খুব ঘটা করে তিনি অন্নপূর্ণা পূজা প্রচার করলেন। পরে কাল পূর্ণ হলে সস্ত্রীক ভবানন্দ মজুমদার স্বর্গারোহণ করে স্বর্গের অধিবাসী স্বর্গে ফিরে গেলেন। তাঁরই বংশধর হলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র-কবি ভারতচন্দ্র তাঁর সভাকবি ছিলেন। পৃষ্ঠপোষকের আদিপুরুষের গৌরব বাড়াবার জন্য কবি সত্য-মিথ্যা ও অতিরঞ্জন মিশিয়ে কাব্য রচনা করেছেন।

Write Reply...