বাংলা সাহিত্যে ছন্দ কি?
ছন্দ কথাটির অর্থ নানা রকম হতে পারে। সাধারণ ভাবে ‘ছন্দ’ শব্দের এক অর্থ ইচ্ছা, অন্য অর্থ কাব্যের মাত্রা’। বলা যায়, ছন্দ অর্থ সৌষম্য।
প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন- “শিল্পীত বাকরীতির নামই ছন্দ।”
তারাপদ ভট্টাচার্য বলেছেন- “ভাষার অন্তর্গত প্রবহমান ধ্বনি সৌন্দর্যই ছন্দ।”
আবদুল কাদির বলেছেন- “শব্দের সুমতি ও সুনিয়ন্ত্রিত বাণীবিন্যাসকে বলা হয় ছন্দ।”
অক্ষরঃ
বাগযন্ত্রের এক প্রয়াসে উচ্চারিত ধ্বনি সমষ্টিকে অক্ষর বলে।
অক্ষর নির্ণয়ের সহজ টেকনিকঃ
শব্দটিকে ইংরেজি তে লিখে যে কয়টা VOWEL (A, E , I , O , U) পাবেন সে কয়টা হবে অক্ষর।
বিশ্ববিদ্যালয় – | B | I | S | S | H | O | B | I | D | D | A | L | O | Y | |||
মোট VOWEL = ৫ | 1 | 2 | 3 | 4 | 5 |
অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটিতে অক্ষর ৫ টি
দুইটি VOWEL পাশাপাশি থাকলে ১ অক্ষর ধরতে হবে। কিন্তু দুইটি VOWEL শব্দের প্রথমে থাকলে আলাদা আলাদা মানে ২ টি অক্ষর ।
বোনাই | B | O | N | A | I |
VOWEL তিনটা কিন্তু অক্ষর ২ টা | ১ | VOWEL পাশাপাশি ২ টা |
কোন শব্দে একটি অক্ষর থাকলে তাকে একাক্ষর শব্দ বলে।
অক্ষর দুই প্রকার (১) মুক্তাক্ষর (২) বদ্ধাক্ষর ।
মুক্তাক্ষর :
যে সব অক্ষর উচ্চারণ কালে আটকে যায় না বা ইচ্ছামত টেনে পড়া যায় তাকে মুক্তাক্ষর বলে।
যেমন : কে, কি, হা, লো, সু, কু ইত্যাদি ।
মুক্তাক্ষর নির্ণয়ের সহজ টেকনিকঃ
কোন শব্দে মুক্ত ভাবে স্বরধ্বনি থাকলরধনি স্বরান্ত (মুক্তাক্ষর) শব্দ বলে।
বদ্ধাক্ষর :
যে সব অক্ষর উচ্চারণ কালে আটকে যায় বা টেনে পড়া যায় না তাকে বদ্ধাক্ষর বলে । যেমন : দিন, বোন, হাত, ডাক, পান, ফুল ।
বদ্ধাক্ষর নির্ণয়ের সহজ টেকনিকঃ
কোন শব্দে মুক্ত ভাবে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলরধনি ব্যঞ্জনান্ত (বদ্ধাক্ষর) শব্দ বলে।
মাত্রা :
বাংলা কবিতার ছন্দে ব্যবহৃত একটি অক্ষর উচ্চারণের নিম্নতম কাল পরিমাণকে মাত্রা বলে ।
বাংলা কবিতার ছন্দ তিন প্রকারঃ
(১) স্বরবৃত্ত (২) মাত্রাবৃত্ত (৩) অক্ষরবৃত্ত
বাংলা ছন্দে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনারীতি নিম্নে দেয়া হল
ছন্দ | মুক্তাক্ষর | বদ্ধাক্ষর | মাত্রা বিন্যাস |
স্বরবৃত্ত | ১ মাত্রা | ১ মাত্রা | ৪+৪+৪+২ অথবা ৪+৪+৪+৪ |
মাত্রাবৃত্ত | ১ মাত্রা | ২ মাত্রা | ৬+৬+৬+২ |
অক্ষরবৃত্ত | ১ মাত্রা | শব্দের আদি ও মধ্য হলে ১ মাত্রা এবং শেষ হলে ২ মাত্রা। একক বদ্ধাক্ষর হলে ২ মাত্রা। | প্রথম পর্ব ৮ অথবা ১০ মাত্রার |
* মাত্রাচিহ্ন – মুক্তাক্ষরে উপর – ∪ ও বদ্ধাক্ষরের উপর – —
স্বরবৃত্ত ছন্দ :
যে ছন্দের বদ্ধাক্ষর সর্বদাই একমাত্রা ধরা হয় তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে। এ ছন্দকে দলবৃত্ত বা লৌকিক ছন্দ বা শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ বলে। এ ছন্দ ছড়ার ছন্দ নামে পরিচিত ।
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য –
(১) এ ছন্দের প্রথমেই স্বরাঘাত পড়ে
(২) বদ্ধাক্ষর সবসময় একমাত্রা ধরা হয়।
(৩) এ ছন্দের লয় দ্রুত ।
(৪) এ ছন্দ লঘু চপল ভাব প্রকাশের উপযোগী
* মূলপর্বের মাত্রা সংখ্যা চার ।
উদাহরণ :

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ :
যে ছন্দে বদ্ধাক্ষর সর্বদাই দুইমাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয় তাকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য –
(১) এ ছন্দে বদ্ধাক্ষর সবসময় ২ মাত্রার
(২) লয় মধ্যম
(৩) মূলপর্ব ছয় মাত্রার, তবে ৫, ৭, ৮ মাত্রার ও হতে পারে। [পরীক্ষায় সাধারনত মূলপর্ব ছয় মাত্রার গুলই আসে।]
(৪) পঙক্তির শেষে প্রায়ই অপূর্ণ পর্ব থাকে ।
উদাহরণ –

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ :
বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী ছন্দ অক্ষরবৃত্ত। যে ছন্দের প্রথম এবং শব্দের মধ্যবর্তী বদ্ধাক্ষর একমাত্রা এবং শব্দের শেষে বদ্ধাক্ষর দুই মাত্রার তাকেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য –
(১) লয় ধীর বা মন্থর ।
(২) সাধারণত সাধুভাষায় ব্যবহৃত হয়।
(৩) মূলপর্বের মাত্রা ৮ বা ১০ মাত্রার হয় ।
(৪) মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, বদ্ধাক্ষর শব্দের শুরুতে বা মধ্যে ১ মাত্রা, শব্দের শেষ বা পূর্ণ শব্দে থাকলে ২ মাত্রা হয় ।
Note : পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, অমিত্রাক্ষর, মুক্তক প্রভৃতি ছন্দ অক্ষরবৃত্তের অন্তর্গত ।
উদাহরণঃ

মাত্রা নির্ণয়ের সহজ কৌশলঃ
ধাপ ১ – প্রথমে অক্ষর নির্ণয় করেনঃ
এইখানে | তোর | দাদীর | কবর | ডালিম | গাছের | তলে |
eikhane | tor | dadir | kobor | dalim | gacher | tole |
অক্ষর = ৪মুক্তাক্ষর=৪ | অক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=২ |
ধাপ ২ -পর্ব নির্ণয় করেনঃ
দেখেন তো কোথায় কোথায় থামতেছেন।
এইখানে | তোর | দাদীর | কবর | ডালিম | গাছের | তলে |
eikhane | tor | dadir | kobor | dalim | gacher | tole |
পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ |
ধাপ ৩ – মাত্রা নির্ণয় করুনঃ
পর্ব ১ এ যেহেতু মুক্তাক্ষর=৪টি অর্থাৎ মাত্রা ৪ টি ও একটি বদ্ধাক্ষরও আমারা পেয়েছি তাই এটা স্বরবৃত্ত ছন্দ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ স্বরবৃত্ত ছন্দ এর ক্ষেত্রে প্রথম পর্ব সবসময়য় ৪ মাত্রার
এখন বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রার অথবা ১ মাত্রার হতে পারে।পর্ব ১ এ বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা ধরে নেয়ার কোন কারন নাই কারন মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত কোন ছন্দের প্রথম পর্ব ৫ হতে পারে না। তাই পর্ব ১ এ বদ্ধাক্ষর অবশ্যই ২ মাত্রার ধরতে হবে। তাহলে পর্ব ১ এ মোট মাত্রা দাড়ায় ৬ টি , যা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বিন্যাসের সাথে মিলে।
এখন পুরা লাইনে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বিন্যাস অনুযায়ী মাত্রা বিন্যাস করুন। মোট মাত্রা পাবেন ২০ টি
এইখানে | তোর | দাদীর | কবর | ডালিম | গাছের | তলে |
eikhane | tor | dadir | kobor | dalim | gacher | tole |
অক্ষর = ৪মুক্তাক্ষর=৪ | অক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=১বদ্ধাক্ষর=১ | অক্ষর=২মুক্তাক্ষর=২ |
পর্ব ১মাত্রা = ৪+২ =৬ | পর্ব ২মাত্রা = ৪+২ =৬ | পর্ব ৩মাত্রা = ৪+২ =৬ | পর্ব ৪মাত্রা = ২ |
বাংলা সাহিত্যের অলঙ্কারঃ
‘অলঙ্কার’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ভূষণ বা আভরণ। যেসব উপাদান দিয়ে কাব্যের অবয়বকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে তাকেই অলঙ্কার বলে। অলঙ্কার শাস্ত্রের উদ্ভব- প্রাচীন গ্রিসে।
সংস্কৃত আলংকারিক বামনের মতে- ‘সৌন্দর্যই অলংকার’ ।
বাংলা সাহিত্যে অলঙ্কার ২ প্রকার :
১. শব্দালঙ্কার : যেমন— অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি প্রভৃতি ।
২. অর্থালঙ্কার : যেমন- উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, সমাসক্তি, বিরোধাভাস প্রভৃতি।
বাংলা সাহিত্যের রসঃ
ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে ‘রস’ অর্থ আস্বাদন। যা আস্বাদ্য তাই রস। ‘রস’ আসলে সহৃদয়জনের আনন্দময় মানসিক অবস্থা । সাহিত্য পাঠে যখন বিশেষ এক অনুভব চিত্তে সঞ্চারিত হয়ে পাঠক অনির্বচনীয় উপলব্ধিতে কাব্যের ভাবানুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নৈর্ব্যত্তিক আনন্দ অনুভব করে, এই অনুভূতি সঞ্জাত নির্মল মানসিক অবস্থাকেই রস বলে।
আচার্য ভরতের মতে- সাহিত্যবৃক্ষের বীজ— ‘রস’।
অভিনব গুপ্তের মতে- রসই কাব্যের প্রাণ ।
বাংলা সাহিত্যে রস নয় প্রকার :
১. শৃঙ্গার রস ২. হাস্য রস ৩. করুণ রস ৪. রৌদ্র রস ৫. বীর রস ৬. ভয়ানক রস ৭. বীভৎস রস ৮. অদ্ভুত রস ৯. শান্ত রস ।